ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি এটি, সংরক্ষণে নেই উদ্যোগ

ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পরও অবহেলিত ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কুমিল্লায় তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানেই বসবাস করতেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বর্তমানে আবাসস্থলটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
২০১০ সালে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বাড়িটি পরিদর্শন করতে এসে ‘ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও গত ১৫ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ওই অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে সোচ্চার হন। তিনি অধিবেশনে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গণপরিষদে যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায়। সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তিনি ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি তোলেন। তার এ প্রস্তাবে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এতে ক্ষিপ্ত হন। ফলশ্রুতিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে কয়েকবার কারাবরণ করতে হয় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে।

আরও পড়ুন:

‘বাংলা ভাষা এখন আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত না’
জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করতে নোটিশ

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য আগে থেকেই টার্গেটে ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। আর সে কারণেই ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা নগরীর ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ের এই বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে ধরে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। সেখানে ৮৫ বছর বয়সী এই দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। পরে বাবা-ছেলে দুজনকেই হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মরদেহের সন্ধান পায়নি পরিবার।
সাংস্কৃতিক সংগঠক ও ইতিবৃত্ত সাহিত্য সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন রনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাষার মাস এলে আমরা যতটা উচ্ছ্বসিত থাকি, তার চেয়ে বেশি নিষ্প্রভ থাকি বাংলাভাষাকে যারা প্রতিষ্ঠাকল্পে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের অবদানকে চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাদেশের প্রথম মানুষ যিনি ভাষাকে আশ্রয় করে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। অথচ তার বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ নেই। এটা কুমিল্লাবাসীর জন্য দুঃখজনক।’
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নাজমুল বারী চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে বাংলা ভাষার প্রস্তাবক ও ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি রক্ষার দাবিতে আমরা আন্দোলন-সংগ্রামসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও ইতিহাস রক্ষায় তার স্মৃতি সংরক্ষণ করে বাড়িটিকে ভাষা জাদুঘর বানানো হোক।’

See also  ট্রাফিক আইনে আরও ৭৭৬ মামলা, ৬০ গাড়ি ডাম্পিং

ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহসানুল কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ধীরেন্দ্রনাথের বাড়িটি শুধু কুমিল্লাবাসী না, দেশবাসীর গর্বের জায়গা। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো তার স্মৃতিচিহ্ন বিলীন হতে চলেছে। বাড়িটিকে কেন্দ্র করে আরও আগেই অনেক কিছু হতে পারতো। কেন হয়নি এটি না ভেবে, এখনই রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আমিরুল কায়ছার জাগো নিউজকে বলেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি ‘ভাষা জাদুঘর’ করার যে দাবি উঠেছে, তা লিখিত আকারে দেওয়া হলে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। সরকার চাইলে তাদের এই দাবি বাস্তবায়ন করতে পারে। এর বাইরে আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই।’
সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি এলেই কদর বাড়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের। বাকি ১১ মাস পরিবারের লোকজন কীভাবে আছে খোঁজ রাখে না কেউ। বিষয়টি ভাবলেই কষ্ট লাগে।’
এসআর/এমএস

Total
0
Share
Need Help?