দুধ-ভাত ও বাঙালির রসনাবিলাস
সকালবেলা মা রান্নাঘরে দুধ গরম দিচ্ছেন। আজ বাড়িতে পায়েস হবে। কারণ আজ ছোট ভাইয়ের জন্মদিন। এই যেন বাঙালির চিরচেনা পারিবারিক দৃশ্য। একটু উৎসব, একটু স্নেহ, আর তাতে মিশে থাকা দুধের সুবাস।
বাংলা সংস্কৃতিতে দুধ কেবল একটি খাবার উপাদান নয়, এটি একধরনের আবেগ, সম্পর্ক আর চেতনার বহিঃপ্রকাশ। পায়েস থেকে প্রসাদ, নববর্ষের মিষ্টি থেকে বিয়ের দুধ-ভাত সব কিছুতেই দুধ রয়েছে কেন্দ্রে। যুগ যুগ ধরে বাঙালি পরিবারে দুধের এক বিশিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান তৈরি হয়েছে।
বাঙালির যে কোনো আনন্দঘন অনুষ্ঠানে দুধের তৈরি খাবার যেন অপরিহার্য। নবজাতকের জন্মদিন মানেই পায়েস; নববর্ষ মানেই রসমালাই, দই, সন্দেশের উৎসব। ঈদে সেমাই বা ফিরনি সব কিছুর মূলে দুধ। আবার দুর্গাপূজায় মায়ের অঞ্জলিতে দেওয়া হয় দুধে গাঁথা মিষ্টি, আর প্রসাদেও থাকে ক্ষীর। ভোগে দুধের উপস্থিতি আধ্যাত্মিকতায় জুড়ে দেয় পবিত্রতার স্পর্শ।
বাঙালি বিয়েতে ‘দুধ-ভাত’ এক অদ্ভুত রীতির অংশ। নববধূ আর বরকে একসঙ্গে খেতে দেওয়া হয় দুধ-ভাত, যা প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় নতুন জীবনের শুরুর, একসাথে পথ চলার। শুধু খাবার নয়, এই রীতিটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীক যা প্রেম, গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
বাংলা হিন্দু সমাজে দুধ একটি ‘পবিত্র’ উপাদান। পূজায় দুধ দিয়ে ‘অভিষেক’ করা হয়, যজ্ঞে দুধ ঢালা হয় এবং ভোগ প্রস্তুত হয় দুধ দিয়ে। মুসলিম ধর্মেও দুধকে একটি পবিত্র ও স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে ধরা হয়। হাদীসে উল্লেখ আছে, দুধকে জান্নাতের পানীয় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
বাঙালি পরিবারে শিশুর প্রথম শক্তি আসে মায়ের বুকের দুধ থেকে। এরপর গরুর দুধ যোগ হয় পুষ্টির অংশ হিসেবে। ‘দুধ-ভাত খাওয়াও, তাহলে হালকা-পাতলা থাকবে না’ এই কথাটি বহু মা-দাদির মুখে শুনেছি। দুধ যেন কেবল শরীরের জন্য নয়, মন ও আবেগেরও প্রতীক।
‘দুধে-ভাতে থাকো’ এই দোয়া আমাদের অনেকেই করে থাকে। দুধ এখানে সুখ, শান্তি আর সমৃদ্ধির প্রতীক। আবার বাংলার গল্প, গান, ছড়া, কবিতায়ও দুধের ব্যবহার এসেছে নানাভাবে। তাইতো ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের পৌরাণিক মঙ্গলকাব্য অন্নদামঙ্গলে তিনি বলেছেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’
বাংলার গ্রামীণ সমাজে দুধ-ভাত কেবল খাবার নয়, বরং তা ছিল সৌহার্দ্য ও আতিথেয়তার অংশ। পুরোনো দিনে কেউ মন কষাকষি করলে কিংবা কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবসানে, গ্রামের মানুষজন আপ্যায়নের মাধ্যমে সম্পর্ক জোড়া লাগাতো। অনেক সময় মুরব্বিরা বলতেন, ‘এসো, একসঙ্গে দুধ-ভাত খাই…মনোমালিন্য থাকুক দূরে।’ এইভাবে এক প্লেট দুধ-ভাত হয়ে উঠত সম্প্রীতির সেতুবন্ধন।
শুধু ঐতিহ্যে নয়, দুধ এখন বাণিজ্যিকভাবেও বাঙালির সংস্কৃতির অংশ। দুধ দিয়ে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম, কাস্টার্ড, মিল্কশেক, চকলেট। নগরজীবনে আধুনিক রেস্টুরেন্টেও গুঁড়া দুধের চা, মালাই লাচ্ছি, দুধসরা চুইমুই নানান উদ্ভাবনী পদ জায়গা করে নিচ্ছে।
দুধ নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, রাখা ভালো আজ বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। ২০০১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এই দিনটি ঘোষণা করে দুধের পুষ্টিগুণ, কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে দুধের অবদান এবং মানুষের জীবনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরার জন্য। এ দিনটি প্রতিবছর বিশ্বের নানা দেশে পালন করা হয় নানা আয়োজনের মাধ্যমে। বাংলাদেশেও এই দিবসে আলোচনা সভা, র্যালি এবং দুধ বিতরণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
দুধ শুধু পুষ্টির উৎস নয়, এটি একটি জাতির আবেগ, বিশ্বাস, ভালোবাসা আর সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। পায়েস থেকে প্রসাদ, দুধ-ভাত থেকে দই…দুধ বাঙালির রান্না ঘরের সঙ্গে যেমন জড়িত, তেমনি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর সঙ্গেও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত। সময় বদলালেও, দুধের এই সংস্কৃতি আজও বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে গর্বের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
চুলের মুঠি গাছে বেঁধে ঝুলে রইলেন ২৫ মিনিট
বাংলাদেশি হিসেবে যারা জয় করেছেন মাউন্ট এভারেস্ট
কেএসকে/এমএস